ড্যান্ডি’র ভয়াবহ নেশায় হবিগঞ্জের পথ-শিশু অন্ধকারে ধাবিত হচ্ছে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম
তারিখ: ২৬-জুলাই-২০১৬
এম এ আই সজিব ॥

পলিথিন ব্যাগ ফুলিয়ে দল বেঁধে হাটছে কয়েকজন শিশু। এরা একজন আরেকজনের পলিথিন ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। অনেকেই হয়তো ভাবছেন এটি শিশু সুলভ আচরণ। আর হওয়ারই কথা। বুঝার উপায় নেই যে, পলিথিনের মুখ ঢুকিয়ে শিশুরা যা গ্রহণ করছে এই জিনিসটাই তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে  নিকষ কালো  অন্ধকার জগতে। পলিথিন ব্যাগের ভেতর নাক মুখ ঢুকিয়ে শ্বাস নেয়াই এখন নেশায় পরিণত হয়েছে হবিগঞ্জ শহরের খোয়াই নদীর পাড়ের বস্তির অধিকাংশ শিশুদের। এ নেশা থেকে বাদ নেই মেয়ে শিশুরাও। সম্প্রতি শহরের বদিউজ্জামান খান সড়কের পাশে মোদক ফার্মেসির সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো আছমা, ছইদ, দেলোয়ার, রিপন। এদের বয়স ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। এরা সবাই খোয়াই নদীর পাড়ের বস্তির বাসিন্দা। হঠাৎ তাদের মাঝে লেগে যায় ঝগড়া। রাস্তায় বসে চিৎকার করে কাঁদছে আছমা। কান্নার কারণ জানতে চাইলে বলে “ আমার মাল লইয়া গেছে গ্যা সৈয়ইদা।” কি মাল? পাশে এক শিশুর উত্তর আছমার ড্যান্ডি সৈয়ইদ্যা লইয়া গেছে। ড্যান্ডি কি ? নিরুত্তর। সকলের হাতে পলিথিনের ব্যাগ রেখেই বলছে ‘আমরা ড্যান্ডি খাই না।’ একজন আরেকজনের ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। এদের একজনের নিকট থেকে জানা গেল ড্যান্ডির মূল রহস্য। ড্যান্ডির আভিধানিক অর্থ জানা নেই। ড্যান্ডি গ্রহণকারী শিশুদের সাথে কথা বলে জানা গেল পলিথিনের ব্যাগে ভরা হয় জুতা কিংবা কাঠে ব্যবহৃত সলিউশন (আঠা)। এরপর ব্যাগের ভেতর বার কয়েক শ্বাস টানলেই মাথা ঝিম ঝিম করে। চোখে নেমে আসে ঘুম ঘুম ভাব। জুতার আঠা বা সলিউশন (আঠা) নিষিদ্ধ কোনো বস্তু নয়। যে কারণে শহরের নিদিষ্ট কিছু দোকান থেকে সহজে এ আঠা কিনতে পারে এই শিশুরা। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় দেখা গেছে, প্রকাশ্যে দলবেঁধে ড্যান্ডির নেশা নিচ্ছে নিম্ন আয়ের পরিবারের এসব শিশু। হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পাড়ে প্রায় ৫শ পরিবার বস্তিতে বাস করেন। অভিবাবকরাও সন্তানদের তেমন খোঁজ খবর রাখেন না। ভোরে এরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। ড্যান্ডির টাকা যোগাড় করতে এদের কেউ কেউ পুরনো কাগজ, লোহালক্কড় কুড়ানো, কেউ ভিক্ষে, কিংবা সুযোগ বুঝে বাসাবাড়ী থেকে ছোটখাট জিনিসপত্র চুরি করে থাকে। নেশা হলেই গ্রহণ করে ড্যান্ডি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল  সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নদীর পাড়ে ও ব্রিজের নিচে বসে ড্যান্ডি খাওয়ার আসর। শুধু হবিগঞ্জ শহরেই নয়, শায়েস্তাগঞ্জ জংশন এলাকাতেও এর বিস্তার অধিক হারে বেড়ে চলেছে। জেলা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের সহকারী উপ-পরিদর্শক মোঃ শাহ্ আলম জানালেন পথশিশুদের ড্যান্ডি আসক্তির বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তিনি বলেন আমাদের আইনে ড্যান্ডি নামে কোনো মাদকদ্রব্য নেই। ড্যান্ডি এখনো আইনের আওতায় আসেনি। এ ব্যাপারে সদর থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, কিছু সংখ্যাক পথশিশুর ড্যান্ডি আসক্তির ব্যাপারে আমাদের কাছে তথ্য আছে। কয়েক দিন আগে আমরা কয়েকজন ড্যান্ডি আসক্ত পথশিশুকে আটক করি। আটককৃত শিশুদের বয়স ৬ থেকে ৭ বছর। পরে তাদের মা বাবাকে ডেকে এনে তাদের জিম্মায় দেয়া হয়। তিনি বলেন, ড্যান্ডি আসক্ত বেশিরভাগই শিশু। শিশু অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। শিশুদের অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখতে শাস্তির চেয়ে সচেতনতা বেশি প্রয়োজন। তাই কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে ঐ সব এলাকায় সচেতনতা মূলক ক্যাম্পেইন করবো। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের এলাকা ভিত্তিক কমিটিগুলো পূর্ন গঠন কাজ চলছে। কমিটি গঠন করার পরই জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সচেতনতামূলক সভা করার কর্মসূচী আছে আমাদের। ড্যান্ডি আসক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে চাইল্ড সাইকোলজিস্ট ডাঃ দীপংকর বড়–য়া বলেন, শিশুকাল থেকে যদি কেউ এ নেশায় আসক্ত হয় তাহলে সেই শিশু বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হবে। এরমধ্যে রয়েছে চিরস্থায়ী শ্বাসকষ্ট (সিওপিডি), রক্তনালী সংকোচিত হওয়া, যৌন অক্ষমতা, কিডনি ফেইলর, কিডনি নেফরাইটিজ, মাংসপেশি ক্রমশ দুর্বল হবে, মানসিক বৈকুল্যতা (সিজোফ্রেনিয়া) ইত্যাদি। এ ধরনের রোগীদের সুস্থ করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পারিবারিক সার্পোট। তাদের জন্য দরকার সম্মিলিত চিকিৎসা, বিশেষ করে কাউন্সিলিং থেরাপি।

প্রথম পাতা