শুভ জন্মদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা
তারিখ: ২৮-সেপ্টেম্বর-২০১৬

ফয়সল ওয়াহেদ

পিতা মুজিব তার আত্মজীবনীতে বলেছেন হাসুর (শেখ হাসিনা) সাথে পিতা মুজিবের স্মৃতিকথাগুলো, সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন হাসু পিতা মুজিবকে কেমন করে ভালবাসতেন। ১৯৫০ সালের জুন মাসের শেষে কোন একদিন পিতা মুজিব ফরিদপুর জেল থেকে গোপালগঞ্জ জেলে স্থানান্তরিত হবেন। সঙ্গে ছিল বেশ কয়েকজন পুলিশ। তিনি লিখেছেন-গোপালগঞ্জ পুলিশ স্টেশন ঘাটে আমাদের নৌকা পৌছা মাত্রই দেখলাম- আব্বা, আম্মা, রেনু (শেখ হাসিনার আম্মা), হাসিনা ও কামালকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় এক বছর পর তাদের সাথে আমার দেখা। হাসিনা আমার গলা ধরে আর ছাড়তে চায় না। শেখ হাসিনার বয়স সেদিন ছিল ৪ বছর। এর মাত্র ২৫ বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে মিষ্টি মিশ্রিত এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে সেখানকার তৎকালীন বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন সাহেব জার্মান থেকে হুমায়ুন রশিদ সাহেবের কাছ থেকে টেলিফোনে জানতে পারেন বাংলাদেশে সামরিক অভ্যূত্থান ঘটেছে। তার আব্বাসহ অনেকেই নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন ব্রাসেলসে মহিউদ্দিন সাহেবের বাসায়। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করে বলেছেন “আমরা শুনেছিলাম মা ও রাসেল বেঁচে আছে। জার্মানীর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এ ধরণের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট বন থেকে দিল্লি ফেরার পথে প্লেনে থাকাকালে জানতে পারলাম কেউ বেঁচে নেই, সবাই নিহত হয়েছেন। খবরটি শুনেই আমার পৃথিবীতে আধার নেমে আসে। দুচোখে কষ্টের শ্রাবণধারা  নামল। বেদনায় বুক ভেঙে খান খান হয়ে গেল”। তারপর লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ অশ্র“ গাঁথা ও রক্তভেজা ইতিহাস বয়ে গেল বহুপথ। আজ শেখ হাসিনার ৭০তম শুভ জন্মদিন। একজন স্বতঃস্ফুর্ত, সাহসী, ঝলমলে বাঙালী নারী। এখন তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সারি সারি টিউলিপ ফুলে ঘেরা কোন এক শহরের পথ অতিক্রম করছেন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধুমতি নদীর অদুরে টুঙ্গিপাড়া নামক ছোট্ট একটি ছায়া সুনিবিড় শান্ত কোমল শীতল গ্রামে আশ্বিন মাসের এক মধ্য দুপুরে মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার বুক আলোকিত করে দাদা শেখ লুৎফুর রহমান ও দাদী শেখ সায়েরা খাতুনের চোখের তারা হয়ে জন্ম নিল হলুদ গাত্র বর্ণ আর বিড়াল মাখা চোখের ছোট্ট শিশু শেখ হাসিনা। নামটি রেখেছিলেন তার দাদা শেখ লুৎফুর রহমান। পিতা মুজিব তখন কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে বিএ পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। শেখ হাসিনার জন্মের মাত্র দেড় মাস আগে মোহাম্মদ আলীর জিন্নাহর তত্ত্ব্ েভারত পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পিতা মুজিব তখন ২৭ বছরের এক টগবগে তরুন ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জনপ্রিয় এক ছাত্রনেতা। ফলে রাজনৈতিক পরিবেশে, রাজনৈতিক পরিবারে, রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তার বেড়ে উঠা। শেখ হাসিনা তার ‘স্মৃতির দখিণ দূয়ার খোলা’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন- গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামখানি এক সময় মধুমতি নদীর তীরে ছিল। বর্তমানে মধুমতি বেশ দুরে সরে গেছে। তারই শাখা হিসাবে পরিচিত বাইগার নদী এখন টুঙ্গিপাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে কুল কুল ছন্দে ঠেউ তোলে বয়ে চলেছে। রোদ ছড়ালে বা জোৎস্না ঝড়লে সে নদীর পানি রোপোর মতো ঝিকঝিক করে। নদীর পাশ ঘেষে কাশবন, ধানক্ষেত, সারি সারি খেজুর-তাল-আমলকি গাছ, বাঁশ, কলাগাছের ঝাড়, বুনো-লতা-পাতার জংলা, শালিক চড়–ই পাখিদের কল-কাকলি। সব মিলিয়ে ভীষণ রকম ভালোলাগার এক টুকরা ছবি যেন। স্মৃতিচারণ করে আরো লিখেছেন- আমার বাবার এক চাচাতো বোন আমার চেয়ে বয়সে তিন-চার বছরের বড় হবে। সেই ফুফুর সাথে বাড়ির সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছি। খালের উপর ছিল বাঁশের সাকো। সেই সাঁকোর উপর দিয়ে যেতে হবে। প্রথম দিন কি দারুণ ভয় পেয়েছিলাম। আমার হাত-পা কাঁপছিল। ফুফুই আমাকে সাহস দিয়ে হাত দিয়ে  সাঁকো পাড় করে দিয়েছিলেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নদীর ধারে বেড়ানো, শীতের দিনে নদীর উষ্ণ পানিতে পা ভিজানো আমার কাছে ভীষন রকম লোভনীয় ছিল। বৈশাখের কাচা আম পেড়ে কুচি কুচি করে শর্ষেবাটা ও কাচা মরিচ মাখিয়ে তারপর কলাপাতা কোনাকোনি করে সেই আমমাখা মুখে পুরে তার রস টেনে খাওয়ার মজা ও স্বাদ আমাকে এখনও আপ্লুত করে রাখে। এভাবে আম খাওয়া নিয়ে কত মারামারি করেছি। ডাল ঝাকিয়ে বড়ই পেড়ে কাড়াকাড়ি করে খেতাম। গ্রামের বড় তালাবের পাড়ে ছিল বিরাট এক বড়ই গাছ। ঝাকুনির ফলে লালের আভা লাগা সবথেকে টলটলে বড়ইটা পুকুরের গভীর পানিতে গিয়ে পড়ত এবং কারো পক্ষে কিছুতেই যখন সেটা তুলে আনা সম্ভব হত না তখন সেই বড়ইটার জন্যে মনে জোরে থাকা দুঃখটুকু আজ ভুলতে পারলাম কই? শৈশবে শেখ হাসিনা ভালবাসতেন টুঙ্গিপাড়ার নরম মাটিতে দীর্ঘপথ পায়ে হাটতে, রাজহাঁসের সারির পিছনে পিছনে দৌড়ে হাঁস ধরে তার লম্বা গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতে। গ্রামের বাড়িতে প্রায়ই কাঁধে ভর দিয়ে মুড়ালিওয়ালা আসত প্রতিদিন বিকেলে। সেই মুড়ালীওয়ালার ঝনঝন শব্দ শুনে দৌড়ে উঠান পেড়িয়ে ছুটে যেতেন তার কাছে। মুড়ালীওয়ালা এক দিন না আসলে ভীষণ মন খারাপ করতেন ছোট্ট শেখ হাসিনা। স্মৃতিকথায় শেখ হাসিনা নিজ হাতে লিখেছেন-টুঙ্গিপাড়ার পাটক্ষেতের ভিতর দিয়ে আমরা ছোট্ট ডিঙি নৌকায় ঘুরে বেড়াতাম। আমার দাদার একটি বড় নৌকা ছিল। যার ভেতর দুটো ঘর ছিল, জানালাও ছিল বড় বড়। নৌকার জানালায় বসে দুর আকাশ আর দুরের ঘন সবুজ গাছপালা ঘেরা গ্রাম দেখতে আামার খুব ভালো লাগত। আমার বাবার জন্মস্থানও টুঙ্গিপাড়ায়। তিনি এখন এই গ্রামের মাটিতেই ছায়া শীতল পরিবেশে ঘুমিয়ে আছেন। তার পাশেই আমার দাদা-দাদীর কবর। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাসে ফেব্র“য়ারীর ২২ তারিখ শেখ মুজিবকে গোপালগঞ্জ জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার কয়েকদিন পরে দাদা শেখ লুৎফুর রহমানের হাত ধরে মধুমতি ও  পদ্মা নদী পাড় হয়ে নৌকায় চড়ে ঢাকায় আসেন ছোট্ট শেখ হাসিনা। তারপর পরিবারের সাথে ঢাকায় রজনী বোস লেনে একটি বাসা ভাড়া করে বসবাস করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ মে শেখ মুজিব মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার পর সবাই ৩নং মিন্টো রোডের বাসায় উঠেন। পিতামাতা তখন ছোট্ট শেখ হাসিনাকে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করে দেন। মিন্টো রোড থেকে প্রভাতবেলা সহপাঠীদের সাথে পায়ে হেটেই স্কুলে যেতেন ছোট্ট শেখ হাসিনা। ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে মার্শাল ল জারি করার পরপরই শেখ হাসিনা ছাত্র রাজনীতিতে বহ্নিশিখার মত সরব হয়ে উঠেন। তিনি যখন আজিমপুর গার্লস স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্রী তখন পাকিস্তানের সামরিক সরকার পৌরনীতিতে আইয়ুব খান ও তার কার্যাবলী পাঠ্যসূচিভূক্ত করে। পরীক্ষার খাতায় আইয়ুব খানের সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। এ অপরাধে শিক্ষক তার উত্তরপত্র বাতিল করে দেন। ১৯৬২ সালের ৩১ জানুয়ারী জেনারেল আইয়ুব খান তৎকালীন পাকিস্তান আওয়ামীলীগ সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করেন। একই সময়ে আইয়ুব খান অগণতান্ত্রিক হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি ও হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা দূর্বার ছাত্র আন্দোলনের শেখ হাসিনা রাজপথের অগ্রভাগে থেকে তখন সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে শেখ হাসিনা ইডেন গার্লস কলেজে ভর্তি হন। তখন ছয়দফা আন্দোলন শুরু হয়। ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরই তিনি ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের সভাপতি ও পরবর্তীতে ছাত্রসংসদের প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৮মে নারায়নগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেওয়ার পর শেখ মুজিবকে আইয়ুব মোনায়েম চক্র গ্রেফতার করে। আওয়ামীলীগ ১৯৬৬ সালের ৬ জুন শেখ মুজিবের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ও ছয়দফা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী হরতাল আহবান করে। পুলিশের গুলিতে সেদিন ১১ জন ছাত্র নিহত হয়। শেখ হাসিনা তখন ছয়দফার জন্য দেশব্যাপী গড়ো উঠা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন সম্পর্কে স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা এক সাক্ষাৎকারে বলেন-আমি পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে বাবাকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাছ থেকে দেখেছি। খাবার টেবিলে যখন আমরা বাবার সাথে খেতে বসেছি কিংবা দুর্লভ সব মুহুর্তে বাবাকে ঘিরে বসে গল্প শুনছি, গল্প করছি। তখন হঠাৎ বাবা বলতেন, এখন চুপ, বলতো কি আমাদের প্রতিজ্ঞা? আমরা ট্রেনিংপ্রাপ্তের মতো ছটপট ছয় আঙ্গুল তুলে বসে থাকতাম। বাবা খুব খুশি হতেন। হ্যাঁ, এই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা। বাবা সংগ্রাম করছেন ছয়দফার জন্য। এতএব আমরা তার সাথে একাতœ হয়ে এই সংগ্রামে শরীক হয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে ৬৯ এর গণঅভূত্থানের সময় বাবা যখন খাবার টেবিলে খেতে বসতেন বা কথা বলতেন তখন ছয় আঙ্গুল তুলেই পাঁচ আঙ্গুল সরিয়ে তিনি বলতেন এখন শুধু এক দফা।

প্রথম পাতা
শেষ পাতা