শিক্ষক রাজনীতির খপ্পড়ে টালমাটাল মিরপুর কলেজ
তারিখ: ১৭-সেপ্টেম্বর-২০১৯
স্টাফ রিপোর্টার ॥

বাহুবলের আলিফ সোবহান চৌধুরী সরকারি কলেজে সিনিয়র-জুনিয়র দন্দে লাটে উঠছে শিক্ষার পরিবেশ। কতিপয় শিক্ষকদের ‘অসভ্যতার’ কারণে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ সিনিয়র শিক্ষকরা রীতিমত দিশেহারা। এ অবস্থায় প্রায় ১৫দিন বন্ধ ছিল কলেজের পাঠদান কার্যক্রম। জুনিয়র শিক্ষকদের করা একটি বিতর্কিত অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসনের তদন্তের মুখে পড়েছেন কলেজটির ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান রতন দেব। চলছে পুলিশি তদন্ত। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী ছবি অধ্যক্ষের রুমে নেই অভিযোগ তুলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমানকে তার কক্ষে ৬ ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন জুনিয়র শিক্ষকরা। জোরেশোরে ছাত্র রাজনীতি না থাকলেও শিক্ষক রাজনীতির খপ্পড়ে পড়ে টালমাটাল হয়ে পড়েছে কলেজের অভ্যন্তরীন পরিবেশ।

কলেজ সূত্র জানায়, এসব ঘটনায় ১২ জুনিয়র শিক্ষককে শোকজ করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। শোকজপ্রাপ্ত শিক্ষকরা হলেন, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক প্রভাষ চন্দ্র পাল, মাসুদুর রহমান মাসুক, মুকিত মিয়া ও নাসরিন জাহান উর্মি, অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ ফরহাদুর রহমান, ফয়সল আহমেদ ও মিঠুন শর্ম্মা, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক আবুল খায়ের, তোফাজ্জ্বল হোসেন ও সোহেল মিয়া এবং বাংলা বিভাগের প্রভাষক জামাল উদ্দিন ও শামীম মিয়া। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মাসুদুর রহমান মাসুকের নেতৃত্বে ইংরেজি বিভাগের ৪ শিক্ষকসহ শোকজ প্রাপ্ত ১২ জন শিক্ষক গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস বর্জন করে আসছেন। শোকজ প্রাপ্ত অন্যান্য শিক্ষক কলেজে অরাজকতা তৈরি করা ছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলমান ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় কক্ষ পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন না করে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। এমনকি গত ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার একটি অসত্য অভিযোগে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী ও কলেজ ছাত্রলীগকে উসকে দিয়ে কলেজের পরিবেশকে অশান্ত করে তোলার পেছনেও শোকজপ্রাপ্ত দুই/তিন জন শিক্ষক সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া শিক্ষকের স্ট্যাটাস থেকেও চাকুরিবিধি লঙ্গনের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কলেজটি সরকারি হওয়ার আগপর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন, সাবেক সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। ওই সময়ে কলেজে কিছু বিষয়ে অনার্স কোর্স খোলার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা মানতে হবে অনার্স শ্রেণিতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের। কিন্তু এরইমধ্যে কলেজটি সরকারি হয়। সরকারি হওয়ার পর শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্মীকরণের কাজ শুরু হয়। আর এতেই কপাল খুলে যায় অনার্সে নিয়োগে পাওয়া শিক্ষকদের।

জানতে চাইলে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান এ প্রতিনিধিকে বলেন, নানা অন্যায় আবদারে রাজি না হওয়ায় জুনিয়র শিক্ষকদের কর্মকান্ডে কলেজটির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, জুনিয়রদের কথা না শুনলেই তারা যা খুশি করছে। তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান রতন দেবের বিরুদ্ধে একটি ভূয়া অভিযোগ দাখিল করেছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউএনও উপজেলা মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার নেতৃত্বে তদন্ত কমিটিও গঠন করেছেন। এছাড়া গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে পাঠদান না করে কলেজের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগে ১২ জন শিক্ষককে শোকজ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। জুনিয়র শিক্ষকদের পেছনে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে তাদের খূঁজে বের করার জন্য কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান অধ্যক্ষ।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের একজন শিক্ষক জানান, ওই তদন্ত কমিটিতে বাহুবল থানার ওসিকে (তদন্ত) রাখা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান রতন দেব কি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছেন, কোথাও কিছু চুরি করেছেন? এগুলো তিনি করেননি। তিনি কলেজ শিক্ষক। উত্থাপিত অভিযোগকে কেন্দ্র করে কলেজ শিক্ষকের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ তদন্ত করবে কোন কারণে? ইউএনও’র তত্ত্বাবধানে এখন কলেজ পরিচালিত হয়। তারমানে এই নয়, তিনি অভিযোগ পাওয়া মাত্রই যাচাই-বাছাই না করেই তদন্ত কমিটি গঠন করে ফেলবেন?

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পদসৃজনের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজে জুনিয়র শিক্ষকদের নেয়ারই কোনো সুযোগ নেই। তবুও তারা যেতে চায়। কলেজের কোনো আদেশই তারা মানতে চায় না।

১২ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা যথারীতি অধ্যক্ষের নেতৃত্বে সিনিয়র শিক্ষকরা মাইক্রোবাসযোগে ঢাকায় যাত্রা শুরু করেন। মিরপুর থেকে অধ্যক্ষসহ সিনিয়র শিক্ষকরা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার পরই একজন জুনিয়র শিক্ষকের নেতৃত্বে জুনিয়র শিক্ষকরা নিজেদের ভাড়াকরা মাইক্রোবাসে ঢাকায় রওয়ানা দেয়। মাউশিতে সভা শুরু হলে দেখা যায়, অধ্যক্ষ এবং সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে এক জুনিয়র শিক্ষক সভার ভেতরে চেয়ারে বসেন। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, কলেজের ৪ শিক্ষক ছাড়া সবাইকে বাইরে যেতে হবে। কিন্তু একজন জুনিয়র শিক্ষক না বেরোলে নিজের ইজ্জত রক্ষায় এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমানই বাইরে চলে আসেন। ভেতরে থাকেন ৩ জন সিনিয়র শিক্ষক এবং জুনিয়র শিক্ষক। অর্থাৎ মিরপুর আলিফ সোবহান চৌধুরী সরকারি কলেজের পদসৃজনের সভা হয়েছে অধ্যক্ষ ছাড়া। মূলত ওখান থেকেই অধ্যক্ষের ওপর ক্ষিপ্ত হন জুনিয়র শিক্ষকরা।

জানা যায়, কলেজের অধ্যক্ষকে নিয়ে ফেসবুকে স্পর্শকাতর বিষয়ে ষ্ট্যাটাস দেয়ার পর চারদিকে আলোড়ন তুলে। হঠাৎ করে কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে কেন জাতির জনক এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি নেই-এর কারণ খূঁজতে গিয়ে জানা গেল, অধ্যক্ষের কক্ষে মেরামত কাজ হচ্ছে। একারণে ছুবি দুটি নামিয়ে রাখা হয়েছিল। কাজ চলার সময় অধ্যক্ষ আরেকটি কক্ষে বসে দাপ্তরিক কাজ সেরেছেন। যে কক্ষে দাপ্তরিক কাজ সেরেছেন সেখানে অধ্যক্ষের মাথার ওপরে জাতির জনক এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি টানানো হয়েছিল বলে সিনিয়র শিক্ষকরা জানিয়েছেন।