টাকার নেশায় মাতোয়ারা চুনারুঘাটের সাব-রেজিস্ট্রার ॥ দুদকের তদন্ত শুরু ॥ বেতন নেই, ভাতা নেই তবুও তিনি কোটিপতি! প্রতিবাদকারী দলিল লিখকদের লাইসেন্স কেড়ে নেয়ার হুমকি ॥ হয়রানীর শিকার হাজার হাজার মানুষ
তারিখ: ২০-সেপ্টেম্বর-২০১৮
দিদার এলাহী সাজু ॥

নাম- আবু বকর মোঃ খায়রুজ্জামান; চুনারুঘাটের সাবরেজিস্ট্রার। বেতন নেই, ভাতা নেই তবুও তিনি কোটিপতি। সীমাহীন-এন্তার অভিযোগ তার বিরোদ্ধে। এতসবের পরও টাকার নেশায় মাতোয়ারা-বেপরোয়া তিনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকর মোঃ খাইরুজ্জামান চুনারুঘাটে যোগদানের পর থেকেই দুর্নীতির হুলিখেলায় মেতে উঠেছেন। অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি প্রতি মাসে কামাই করছেন লাখ-লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, জমির শ্রেণী পরিবর্তন ও কম মূল্য দেখিয়ে সরকারের রাজস্ব^ ফাঁকি, ১% টাকা ছাড়া দলিল রেজিস্ট্রি না করা, শ্রেণী ঠিক রেখে মুল্য কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি, দলিল দাখিলের জন্য টাকা নেয়া, ‘হেবা’ এবং ‘হেবা বিল এওয়াজ’ দলিলে অতিরিক্ত টাকা নেয়া, বাটোয়ারা দলিলে টাকা আদায়, নামজারি ছাড়া রেজিস্ট্রি, ভুয়া দাতা তৈরী করে দলিল রেজিস্ট্রির চেষ্টাসহ পাহাড়সম অনিয়ম-দুর্নীতির। শুধু তাই নয়, অভিযোগ রয়েছে, দলিল লেখকদের মধ্যে গ্র“পিং তৈরী করে স্বার্থ হাসিল, ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে অশোভন আচরন এবং কখনো কখনো এজলাসে না বসেই দলিল রেজিস্ট্রি  করেন তিনি। তার এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরোদ্ধে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা ছাড়াও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত ও মৌখিক ভাবে অসংখ্য অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, মাত্র দুই বছরের বেশি সময় চুনারুঘাটে চাকুরি করে বেতন-ভাতা ছাড়াই কোটি-কোটি টাকার গাড়ি-বাড়ি ও সম্পদ অর্জন করেছেন সাময়িক ভাবে বরখাস্থ হওয়া এ সাব-রেজিস্ট্রার। তিনি সাতক্ষীরা জেলায় চাকুরিকালীন সময়ে নানা দুর্নীতির কারণে সাময়িক বরখাস্থ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার বরখাস্থ স্থগিত করা হলেও বেতন-ভাতাদি প্রদান বন্ধ রয়েছে। চুনারুঘাটে যোগদানের পরই তিনি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে অলিখিত নানা নিয়ম চালু করেন। আর এসব অনিয়মের মাধ্যমেই তিনি কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে উপজেলার নিরীহ সাধারণ মানুষ। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল উপজেলার মুছিকান্দি মৌজার ৩১৮ খতিয়ানের ২৩৭ দাগের ৩৮ শতক আমন শ্রেণীর জমি বিক্রি করেন কামাল মিয়া। ক্রেতা আহাদ মিয়া চৌধুরীর ১৬৯৭ নং দলিল রেজিস্ট্রি করেন সাব-রেজিস্ট্রার। এ জমির সরকারি মুল্য প্রতি শতকে ৭০ হাজার ৮শ ২ টাকা হিসেবে ২৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা হলেও তিনি দলিলে সাইল দেখিয়ে জমির মুল্য প্রতি শতকে মাত্র ৮ হাজার ৬শ ৮৩ টাকা হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেখিয়েছেন। এতে সরকারের ২ লাখ ১৩ হাজার টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। একই ভাবে বড়াইল মৌজার ১৯৩৮ খতিয়ানের ২৬৩ নং দাগের ১৫.৮৫ শতক জমিও কম মূল্য দেখিয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের যোগসাজসে দলিল করেছেন ক্রেতা মতিউর রহমান। ওই মৌজার গুরুত্বপুর্ণ সাইল শ্রেণী জমির সরকারি মূল্য হচ্ছে প্রতি শতকে ১ লাখ ৩২ হাজার ১শ ৩০ টাকা হিসেবে ১৫.৮৫ শতকের মুল্য ২০ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। অথচ তিনি দলিলে দেখিয়েছেন প্রতি শতকে ৯৫ হাজার টাকা। এখানে বড় অংকের সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, এসব ক্ষেত্রে তিনি মোটা অংকের টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকেন। এভাবে তিনি বহু দলিল রেজিস্ট্রিতে কম মুল্য দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পাশাপাশি সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে বিপুল পরিমান টাকা।

সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের একটি বিশ্বস্থ সূত্র জানায়, প্রতিদিন তার কার্যালয়ে যত দলিল রেজিস্ট্রি হয় তার প্রত্যেকটির বিপরীতে নেয়া হয় ১ হাজার টাকা করে। পাশাপাশি প্রত্যেক দলিলের মুল্যের অনুপাতে শতকরা ১% হারে কমিশন দিতে হচ্ছে। কমিশন ছাড়া তিনি কোন দলিল রেজিষ্ট্রি করেন না। এছাড়াও ‘হেবা বিল এওয়াজ’ দলিলে উক্ত পরিমান উৎকোচের পর অতিরিক্ত আরো ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। আমমোক্তার দলিলে মূল্যবেধে অতিরিক্ত ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা, বাটোয়ারা দলিলে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, মর্গেজ দলিলে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, কমিশনের দলিলে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেন তিনি।

সূত্র জানায়, তার ব্যক্তিগত সহকারিকে (মাস্টাররোলে কর্মরত) পাঠিয়ে তিনি কমিশনে দলিল সম্পাদন করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কোন দলিল গ্রহীতার কোন একটি কাগজ সংকট থাকলেই তাকে অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা গুনতে হয়। আর এসব নিয়ে প্রায়ই সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে দলিল লিখক ও অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সাব-রেজিস্ট্রারের এহেন কর্র্মকান্ডে অতিষ্ট মানুষজন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোন সুরাহা পাচ্ছেন না। টাকা না দিলে জমি রেজিস্ট্রি হয়না। সাব-রেজিস্ট্রার খাইরুজ্জামানের  আইন-ই এখানে সব। তিনি প্রায়ই এজলাসে বসেন না। খাস কামড়ায় বসেই সম্পাদন করেন দলিল রেজিস্ট্রি।

একাধিক দলিল লিখক অভিযোগ করে জানান, তার কথা কোন দলিল লিখক না শুনলে, তিনি তাদের লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দেন। আই.জি.আর-এর ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘টাকা না দিলে লাইসেন্স নবায়ন হবে না’।

জানা যায়, সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকর মোঃ খায়রুজ্জামান অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন নবীগঞ্জ উপজেলায়ও। ফলে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন চুনারুঘাটে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আর এ দু’দিনেই তিনি কামিয়ে নেন কয়েক লাখ টাকা। খাইরুজ্জামানের কারনে জমির ক্রেতা-বিক্রেতাসহ দলিল গ্রহীতারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তার বিরোদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে উপজেলা পরিষদ, জেলা রেজিস্ট্রার এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। একাধিকবার আলোচনা হয়েছে মাসিক আইনশৃংখলা কমিটির সভায়। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সতর্কও করা হয়েছে তাকে। তারপরও তিনি ধমেন যাননি। বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে যাচ্ছেন নানা অনিয়ম আর অপকর্ম। টাকার নেশায় হয়ে পড়েছেন মাতোয়ারা। তার বিরোদ্ধে কেউ কথা বললেই তার উপর নানা নির্যাতন শুরু হয়। সম্প্রতি দলিল লিখক সমিতির সভাপতি আবদুল আহাদ এ বিষয়ে প্রতিবাদ  করলে তার উপর তিনি চড়াও হন। এ নিয়ে তিনি একটি মামলাও দায়ের করেন। তাকে মারধোর ও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে বলে তিনি দলিল লিখক সমিতির সভাপতি, আঃ আহাদ, সেক্রেটারি সাহিদুর রহমান এবং দলিল লিখক দরবেশ আলীর নামে  একটি মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় তিনজনই জামিনে রয়েছেন। মামলাটি তদন্তে রয়েছে। 

এ বিষয়ে আবু বকর মোঃ খাইরুজ্জামান বলেন, ‘আমার কার্যালয়ে কোন অনিয়ম নেই। কারো কাছ থেকে কোন টাকা আদায়ও করা হয়নি। দলিল লিখকদের কেউ টাকা আদায় করেছে, এমন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে’। একটি মহল তার বিরোদ্ধে অপ্রপ্রচার চালাচ্ছে বলেও তিনি দাবী করেন।

এদিকে, গতকাল বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশন হবিগঞ্জের উপ-পরিচালক মলয় কুমার সাহা চুনারুঘাট সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা সাব-রেজিস্ট্রার খাইরুজ্জামানকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে কোন কিছুই প্রকাশ করছেন না দুদকের ওই কর্মকর্তা।

প্রথম পাতা