হবিগঞ্জে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের একটি মামলায় মায়ের মৃত্যুদন্ডের রায় হওয়ায় মায়ের সাথেই ফাঁসির সেলে বন্দী আছে ১০ মাসের শিশু মাহিদা। ১ লাখ টাকা যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে নিহত গৃহবধু আয়েশা আক্তারের পিতা আব্দুস সাত্তার বাদী হয়ে ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টম্বর হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামীরা হল- চুনারুঘাট থানার সাদেকপুর গ্রামের নিহত আয়েশা আক্তারের স্বামী রাসেল মিয়া, রাসেল মিয়ার মাতা- তাহেরা খাতুন, ভাই কাউছার মিয়া, বোন রুজি আক্তার ও হুছনা আক্তার। উক্ত মামলায় ৫ আসামীর সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে গত ২৬ অক্টোবর মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করেন হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতের বিচারক জাহিদুল হক। আসামী কাউছার মিয়া পলাতক। অন্য আসামীরা রায় ঘোষনার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষনার দিন মা হুছনা আক্তারের সাথেই আদালতে এসেছিল ১০ মাসের শিশু মাহিদা। রায় ঘোষনার পর মায়ের সাথে মাহিদার জায়গা হয় হবিগঞ্জ কারাগারের ফাঁসির সেলে। হত্যাকান্ডের সময় হুছনা কলেজে লেখাপড়া করতেন। প্রায় দুই বছর আগে একই গ্রামের মিজানুর রহমানের সাথে তার বিয়ে হয়।
ফাঁসির সেলের ধরন, সুযোগসুবিধাঃ-
জেল কোডের ৭৩৫ বিধিতে সেলের কথা বলা হলেও এর আয়তন কি তার উল্লেখ নেই। তবে জানা গেছে- বিভিন্ন কারাগারে ৬ ফুট বাই ৬ফুট থেকে ১০ ফুট বাই ১০ ফুট আয়তনের সেল রয়েছে। হবিগঞ্জ কারাগারে মহিলা বন্দীদের জন্য ২টি সেল রয়েছে। হবিগঞ্জ কারাগারে ফাসির সেলের আয়তন প্রায় ১০ ফুট বাই ১০ ফুট। দুটি সেলের একটিতে রয়েছেন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ষাটোর্ধ তাহেরা খাতুন, তার মেয়ে রুজি আক্তার, হুছনা আক্তার ও হুছনা আক্তারের ১০ মাসের কন্যা মাহিদা আক্তার। তাদের সেলের উত্তর দিকে একটি জানালা, আয়তন প্রায় ৩ ফুট বাই ৩ ফুট। তাও একাধিক টিন দিয়ে শক্ত করে সাটানো, বন্ধ করে দেয়া। কক্ষের দক্ষিন দিকে অন্তত ১২ মিলিমিটার পুরত্বের ১৪ শিকের (রডের) গেইট। সেলে কোনো দরজা নেই। কক্ষ ঘেষে ছোট আয়তনের একটি বাথরুম। বাথরুমের সামনে প্রায় ৪ ফুট উচ্চতার দেয়াল। বাথরুমের সামনে একটি ভাঙ্গা দরজা। দরজাটা লাগানো যায় না। লোহার শিকের বাহিরে থেকে বড় একটি তালা ঝুলানো। দিনে সুর্যের আলো, জেল কোডের ৯৮৪ বিধি মোতাবেক রাতে থাকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক আলো। বৈদ্যুতিক বাতি নেভানোর কোনো বিধান নেই। ফাসির সেলে বন্দীদের ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষন করে থাকেন কারারক্ষীরা। জেল কোড অনুযায়ী প্রধান কারারক্ষী প্রতি দুই ঘন্টা পরপর, জেলার দিনে দুইবার এবং জেল সুপার দিনে দুইবার বন্দীদের পর্যবেক্ষন করে থাকেন। আত্বহত্যার কোনো উপকরণ আছে কি না সে জন্য ফাসির সেল দিনে দুইবার পরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। সেলের ভেতরে বা বাহিরে কোনো ফ্যান নেই। হবিগঞ্জ কারাগারের ওই সেলে সরাসরি পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। ছোট বালতিতে করে পানি পাওয়া যায়, তাও সবসময় নয়, ওই পানিতেই চলতে হয় তাদের। দন্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক বন্দীকে দেয়া হয়েছে ৩টি কম্বল, একটি করে এলুমিনিয়ামের মগ, প্লেট ও বাটি। একজন সশ্রম কারাবন্দী যে হারে খাবার পান ফাসির সেলে বন্দীদের একই নিয়মে খাবার দেয়া হয়ে থাকে। অতিরিক্ত খাবার বা মিষ্টি দ্রব্য প্রদানে জেল কোড অনুযায়ী বিধি নিষেধ রয়েছে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে দিনে দেড় ঘন্টার জন্য ১০ ফুট বাই ১০ ফুট আয়তনের কক্ষের তালা খুলে দেয়া হয়। তালা খুলে দেয়ার পর দেড় ঘন্টার জন্য ওই কক্ষের শিশু মাহিদাসহ ৪ বাসিন্দার পরবর্তী গন্তব্য কক্ষের সামনের ৬ ফুট বাই ১০ ফুট আয়তনের বারান্দা।
এব্যাপারে হবিগঞ্জ কারাগারের জেলার মাসুদ হাসান জানান-সাধারণ বন্দীদের মতোই সেলে বন্দীরা খাবার দাবার পেয়ে থাকেন। প্রার্থক্য শুধু তাদেরকে সেলে থাকতে হয়। মৃত্যুদন্ড ও কারা অপরাধীদেরকে সেলে রাখার বিধান রয়েছে। মায়ের সাথে সেলে থাকা শিশু মাহিদার জন্য দুধ ও ডিমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি জানান- হবিগঞ্জ কারাগারে মহিলাদের জন্য ২টি এবং পুরুষদের জন্য ১০টি সেল রয়েছে। ছোট সেলে একজন বন্দীকে রাখা হয়, বড় সেলে রাখা হয় সর্বোচ্চ ৩জন বন্দীকে। খোজ নিয়ে জানা গেছে- চঞ্চল ও পুরো বাড়ি মাথিয়ে রাখা শিশু মাহিদা দিন দিন নুইয়ে যাচ্ছে। মাহিদার স্বজনরা জানিয়েছেন- প্রায় একমাসের ব্যবধানে মাহিদার ওজন কমেছে প্রায় ২ কেজি। সদ্য দাত উঠতে শুরু করা মাহিদাকে কোনো ফলমূল পিষিয়ে খাওয়ানোর কোনো সুযোগ নেই, সুযোগ নেই কাদলেই তার মুখে তুলে দেয়ার মতো অন্য খাবার। একটি নির্জন কক্ষে দিনে রাতে সমানতালে আক্রমন করে থাকে মশা। মশারী বা কয়েল ব্যবহারেরও কোনো অনুমতি নেই কারাগারে। একজন গৃহবধু জানিয়েছেন- ১০/১১ মাস বয়সী একটি শিশুর প্রতিদিন কমপক্ষে ২০/২৫টি ছোট কাঁথার প্রয়োজন হয়। নিয়মিত তা ধৌত করতে হয়, শুকাতে হয়। কারাগারে এসব সুবিধা দেয়া সম্ভব নয়। এব্যাপারে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডাক্তার সাইফুর রহমান সোহাগ জানান- মা বাবার সহাবস্থান একটি শিশুকে পরিপর্ণ করতে পারে, শিশুরা দেখে বেশি শিখে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শিশুকে বেশি প্রভাবিত করে, একজন শিশুর শুরু থেকেই কনফিডেন্স তৈরী হয়। ফাসির সেলের যে বর্ণনা জানা গেছে তাতে কোনোভাবেই একজন শিশু পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠবে না, তার মানসিক বিকাশ নষ্ট হয়ে যাবে, কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে যাবে, দীর্ঘদিন ফাসির সেলে থাকার কারণে যে কোনো শিশু মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে যেতে পারে।
মামলার বিবরণঃ
মামলার নথিপত্র দৃষ্টে দেখা যায়- ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্বামীর বাড়িতে খুন হন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাদেকপুর গ্রামে আয়েশা আক্তার নামের এক গৃহবধু। এ ঘটনায় নিহত আয়েশা আক্তারের পিতা আব্দুস সাত্তার বাদী হয়ে আয়েশা আক্তারের স্বামী রাসেল মিয়া, মাতা- তাহেরা খাতুন, ভাই কাউছার মিয়া, বোন হুছনা আক্তার ও রুজি আক্তারকে আসামী করে একটি যৌতুকের জন্য হত্যার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। ওইদিনই আসামী রাসেল মিয়াকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় অপরাধ স্বীকার করে হত্যাকান্ডের সাথে একাই জড়িত মর্মে রাসেল মিয়া ১৮ সেপ্টেম্বর বিচারক শামসাদ বেগমের আদালতে স্বীকারুক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে। ২০১৭ ইং সনের ১৫ মার্চ চুনারুঘাট থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওমর ফারুক আসামী রাসেল মিয়ার বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন। অন্য আসামীদেরকে চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়। বাদীর নারাজীর প্রেক্ষিতে মামলাটি পরবর্তীতে তদন্ত করেন পিবিআই এর ইন্সপেক্টর মোঃ মাইনুল ইসলাম। ২০১৭ ইং সনের ১৯ নভেম্বর পিবিআই এর ইন্সপেক্টর মোঃ মাইনুল ইসলাম আসামী রাসেল মিয়ার বিরুদ্ধেই চার্জশীট দাখিল করেন। অন্য আসামীদের হত্যাকান্ডের সাথে সম্পৃক্ততা নেই মর্মে তাদেরকে অব্যাহতির প্রার্থণা করা হয়। ২০১৮ ইং সনের ২৭ মার্চ বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে হবিগঞ্জের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক) মাফরোজা পারভিন সকল আসামীর বিরুদ্ধে মামলা আমল গ্রহণ করেন। একই বছরের ১৬ জুলাই বিচারক জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১নং আসামী রাসেল মিয়া ব্যতিত স্বেচ্ছায় হাজির হয়ে জামিন প্রার্থী আসামী তাহেরা খাতুন, হুছনা আক্তার ও রুজি আক্তারের জামিন মঞ্জুর করেন। পরবর্তীতে ১২জন স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ শেষে বিচারক জাহিদুল হক গত ২৬ অক্টোবর রায় ঘোষনা করেন। রায়ে ৫ আসামীর সবাইকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে হাইকোর্টে আপিল মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দন্ডিত তাহেরা খাতুনের ভাই তাজুল ইসলাম লাল মিয়া। হাইকোর্টের আইনজীবী মীর নুরুন্নবী উজ্জল জানিয়েছেন- মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত মামলার আসামীদের ডেথ রেফারেন্স শুনানীর জন্য পেপার বুক তৈরী ও আপিল শুনানী করতে কমপক্ষে ৫ বছর লেগে যেতে পারে। মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত মামলার আসামীদের আলাদাভাবে জামিন শুনানীর কোনো সুযোগ নেই।