চর খুবলে নিচ্ছে ভেকুর বেøড
তারিখ: ২৬-এপ্রিল-২০২৪
নুর উদ্দিন সুমন \

চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জ, কলিমনগর-সংলগ্ন খোয়াই নদীর চরের মাটি খুবলে নিচ্ছে মাটিখেকোদের ভেকু। প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে অবৈধভাবে নদীর চর কেটে তোলা এ মাটি বিক্রি করছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। অথচ এ ব্যাপারে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রশাসন। খোয়াই নদীর দুই পাড়ই এখন মাটিখেকোদের দখলে। বাধা দিলে হামলা-মামলায় নাজেহাল করা হয় সাধারণ মানুষকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠুকে দেওয়া হয় মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা। নদীর দু’পাড়ে দিনরাত চলছে মাটি কাটার অবৈধ যজ্ঞ। সর্বনাশ করা হচ্ছে ফসলি জমির। প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা যথেষ্ট নয়। নির্বিচারে মাটি কেটে নেওয়ায় খোয়াই নদীর শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন লেঞ্জাপাড়া, আলাপুর এবং হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর, চুনারুঘাটের রামশ্রী ও করিমপুর এলাকায় নদীর চরে ফসলি জমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। মাটিখেকোরা বাঁধের কাছে তৈরি করেছে পুকুরের মতো বড় বড় গর্ত। ফলে বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ওইসব এলাকা। এ ছাড়া বড় বড় ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টরে মাটি নেওয়ার কারণে নষ্ট হচ্ছে নদীপাড়ের সড়ক। প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে চলে যাওয়ার পর আবার শুরু হয় মাটি কাটা বাহিনীর তাÐব। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামমাত্র অভিযানে এসব স্থানে কাজ করা জনাকয়েক শ্রমিককে অর্থদÐ দেওয়া হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূল হোতারা। তারা আড়ালে থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছে।
সরেজমিন এসব চর এলাকায় দেখা গেছে, এক্সক্যাভেটর (ভেকু) দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি কাটার ফলে নদীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। খালের মতো গর্ত সৃষ্টি হয়েছে মাটি কাটার ফলে। পাশাপাশি চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে প্রতিরক্ষা বাঁধ। আবার বাঁধের ওপর দিয়ে এসব মাটি পরিবহনে অবৈধ ট্রাক্টর ও ড্রাম ট্রাক ব্যবহার করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাঁধসংলগ্ন সড়ক। অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য স্থানে বাঁধ কেটে বানানো হয়েছে গাড়ি ওঠানামার রাস্তা। বিকল্প কোনো রাস্তা না থাকায় আলাপুর ও লেঞ্জাপাড়া গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ যাতায়াতের জন্য এ বাঁধ ব্যবহার করে। সেই রাস্তাও বেহাল এখন। অপরিকল্পিতভাবে নদীর বাঁধ দিয়ে মাটি পরিবহন করায় একদিকে যেমন চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে এলাকাবাসীকে, অন্যদিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খোয়াই নদীর বাঁধ। খোয়াই নদীসংলগ্ন উল্লিখিত এলাকাগুলোতে দিনদুপুরে ভেকু (খননযন্ত্র) দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি কাটার চিত্র প্রকাশ্যে দেখা যায়। গভীর গর্ত করে মাটি কাটায় পরিত্যক্ত খোয়াই নদীর চর ও চরাঞ্চলের ফসলি জমি ডোবায় পরিণত হচ্ছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে শায়েস্তাগঞ্জ ও লস্করপুর ইউনিয়নের কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন ও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এ তাÐব চালানো হচ্ছে। প্রতিবাদ করলেই করা হয় নির্যাতন। স্থানীয় বাসিন্দারা অসহায়। তাদের বোবাকান্না কেউ শোনে না। লেঞ্জাপাড়া গ্রামের কাসেম মিয়া জানান, আদ্যপাশার হায়দার আলীসহ অর্ধশতাধিক লোক মাটি কাটা পেশায় যুক্ত। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবাধে মাটি কাটা পেশার সঙ্গে যুক্ত আরও বেশি মানুষ। তাদের বেশির ভাগ সমাজের উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। অনেকে আবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বলে জানা গেছে। তাদের ভয়ে কেউ কথা বলে না। তারা নদীর বালু লুটের পর এবার চরের মাটি দখল করে কেটে বিক্রি করেন ইটভাটায়। নদী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ট্রাক্টর ও ড্রাম ট্রাক দিয়ে মাটি কেটে নেওয়ার কারণে রাস্তা বেহাল। এমনকি পাকা রাস্তাও খানাখন্দে ভরে গেছে। ওই এলাকার গাছপালা, বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জমেছে ধুলোর স্তর। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফাহিন মিয়া জানান, দীর্ঘদিন ধরে মাটি কাটছে চক্রটি। কাউকে মানে না তারা। দু’বার বাধা দেওয়ায় মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন তিনি। মাটি কাটার কারণে লেঞ্জাপাড়া, আলাপুর ও লস্করপুর একেবারে দূষিত হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নদীর পানি বাড়লে বাঁধ ভাঙার আতঙ্কে থাকে সবাই। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা ও নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, তাদের নজরদারি আছে এ ব্যাপারে। কোনো অভিযোগ কিংবা তথ্য পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবির সঙ্গে যথেষ্ট অসংগতি রয়েছে বাস্তবতার।
পাউবোর এই কর্মকর্তা আরও জানান, নদীর চর কাটলে সমস্যা নেই। সেটি বালুমহালের বিষয়। কিন্তু নদীর চর না কেটে যদি বাঁধ কিংবা নদীর কাছ থেকে মাটি ও বালু উত্তোলন করে, সেটা সমস্যা। এসব ব্যাপারে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জায়গা লিপিবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করা হচ্ছে। তবে কর্তৃপক্ষের এত পদক্ষেপের ফিরিস্তি ¤øান করে দিচ্ছে প্রকাশ্যে চলতে থাকা মাটি কাটার তাÐব। এসব ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেননি সংশ্লিষ্টরা। শায়েস্তাগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার মিতা জানান, এর আগে এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাটি কাটার সঙ্গে জড়িতদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। উপজেলার কোথাও কোনো অনিয়ম হতে দেওয়া হবে না। পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে মাটি ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা সংশ্লিষ্ট নদীর চর দখলকৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে কিনে মাটি ও বালু উত্তোলন করছেন।