সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মায়া হরিণ দেখা মিলছে
তারিখ: ১১-নভেম্বর-২০২৫
মাধবপুর প্রতিনিধি ॥

 হবিগঞ্জের পাহাড়ি অরণ্যে অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান আবারও বন্যপ্রাণীতে মুখর হয়ে উঠছে। গতকাল সোমবার বনের ভেতর দেখা মিলেছে বিরল প্রজাতির মায়া হরিণের। স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এটি এক আনন্দের খবর। বহু বছর পর সাতছড়ির বনে এ ধরনের বন্যপ্রাণী চোখে পড়া প্রমাণ করে যে সংরক্ষণ কার্যক্রম ফল দিচ্ছে এবং প্রকৃতি ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে তার পুরনো প্রাণচাঞ্চল্য।
২০০৪ সালে প্রায় ২৪৩ হেক্টর এলাকা জুড়ে সাতছড়ি বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। তখন থেকেই বন বিভাগ ধীরে ধীরে এখানে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নানা উদ্যোগ নেয়। বনভূমিতে অবৈধভাবে গাছ কাটা, পশু শিকার এবং দখল রোধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। একই সঙ্গে লোকালয়ে ধরা পড়া বিভিন্ন বন্যপ্রাণী—যেমন বানর, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, পেঁচা, বেজি, সাপ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি—উদ্ধার করে এই উদ্যানে অবমুক্ত করা হচ্ছে। এর ফলে বনে আবারও প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী চিত্র দেববর্মা জানান, গতকাল সোমবার সকালে বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি গাছের ছায়ায় ঘাস খাচ্ছে মায়া হরিণ। বনে এখন প্রচুর মায়া হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী দেখা মিলে। ছোটবেলায় বড়দের মুখে শুনেছিলাম যে সাতছড়িতে আগে হরিণ দেখা যেত, এখন আবার চোখে দেখা যাচ্ছে। চিত্র দেববর্মার মতো অনেকেই সম্প্রতি বনজুড়ে বিভিন্ন পাখি, কাঠবিড়ালি ও বন্য খরগোশের উপস্থিতি লক্ষ্য করছেন। বনাঞ্চলের ঘন গাছপালা, পাহাড়ি ঝর্ণা আর শান্ত পরিবেশ বন্যপ্রাণীর জন্য আদর্শ আশ্রয় হিসেবে কাজ করছে।
সাতছড়ি রেন্জের তেলমাছড়া  বিট অফিসার মো. মেহেদী হাসান মাসুদ বলেন, বন সংরক্ষণে আমরা এখন অনেক বেশি সতর্ক। নিয়মিত টহল দেওয়া হয়, স্থানীয়দের সহযোগিতায় অবৈধ প্রবেশ ও শিকার কার্যক্রম প্রতিরোধ করছি। লোকালয়ে ধরা পড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে আমরা সাতছড়িতে ছেড়ে দিচ্ছি, যাতে তারা প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরে যেতে পারে। সম্প্রতি মায়া হরিণ দেখা যাওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। এটি দেখায় যে বনের পরিবেশ এখন প্রাণীদের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠছে।”
তিনি আরও জানান, বন বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়েছে। যাতে তারা বন্যপ্রাণী রক্ষায় সহযোগিতা করে এবং অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তথ্য দেয়। সাতছড়ি সহব্যববস্হাপনা কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম আবুল বলেন, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। এখানে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি, ৩০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং শতাধিক প্রজাতির গাছগাছালি রয়েছে। বনের অভ্যন্তরে রয়েছে পাহাড়ি ছড়া, টিলা, প্রাকৃতিক জলাধার এবং ঘন বৃক্ষরাজি, যা বন্যপ্রাণীর টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য পরিবেশ তৈরি করেছে।
স্থানীয় পরিবেশ কর্মী আব্দুল হক বলেন, “সাতছড়ি শুধু হবিগঞ্জ নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের জন্য একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। এখানে মায়া হরিণ দেখা যাওয়ার খবরটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তবে এই ধারা বজায় রাখতে হলে বনভূমির চারপাশে মানবসৃষ্ট হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং বনের ভেতর কোনো রকম গাছ কাটা বা পশু শিকারের চেষ্টা যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।”
মনতলা সরকারি কলেজের প্রভাষক মারিয়া আক্তার সতর্ক করে বলেন, পর্যটন যেন নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক চলাচলে ব্যাঘাত না ঘটে। অতিরিক্ত শব্দদূষণ ও বর্জ্য ফেলা বনের পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা( ডিএফও)  আবুল কালাম আজাদ  বলেন,সব মিলিয়ে বলা যায়, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান আবারও তার হারানো ঐশ্বর্য ফিরে পাচ্ছে। প্রকৃতি নিজেকে সাজাচ্ছে নতুনভাবে। মানুষের সচেতনতা, বন বিভাগের তৎপরতা এবং স্থানীয়দের সহযোগিতায় এই সংরক্ষিত বন আজ বাংলাদেশের অন্যতম জীবন্ত অরণ্যে পরিণত হচ্ছে।
মায়া হরিণের উপস্থিতি  প্রাণীর ফিরে আসা নয়—বরং এটি প্রকৃতির পুনর্জাগরণের প্রতীক, যা আশা জাগায়, সাতছড়ি আবারও হবে এক প্রাণবন্ত জীববৈচিত্র্যের স্বর্গভূমি।

প্রথম পাতা