দানবীর ও শিক্ষানুরাগী শচীন্দ্র লাল সরকারের পরলোকগমন
তারিখ: ২৩-মে-২০২০
স্টাফ রিপোর্টার ॥

বানিয়াচং উপজেলার প্রবীন শিক্ষানুরাগী হবিগঞ্জের ২য় সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ শচীন্দ্র কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শচীন্দ্র লাল সরকার আর নেই। গতকাল শুক্রবার ভোরে হবিগঞ্জ শহরের ঘাটিয়ায় নিজ বাসভবন বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তিনি স্ত্রী ও আত্মিয়-স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহি রেখে গেছেন। জানা যায়, বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। গতকাল শুক্রবার ভোরে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো হবিগঞ্জ জেলাজুড়ে। দুপুরে বানিয়াচং উপজেলার নাগুড়ায় স্বপ্নের সেই কলেজে তাঁর শেষকৃতি সম্পন্ন হয়।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শোক প্রকাশ করেছেন অনেকে। অনেকে মহান এই মানুষটিকে হারানোর কারণে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করে তিনি নিজ অর্থায়নে বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বলতে গেলে সারাজীবন যা সঞ্চয় করেছেন সব কিছুই তিনি শিক্ষার কল্যাণে ব্রায় করে গেছেন।

তিনি সর্বপ্রথম ১৯৮৪ সালে হবিগঞ্জ শহরে নিজের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন নীরদাময়ী স্কুল। এরপর মনোনিবেশ করেন কলেজ প্রতিষ্ঠায়। ১৯৯৪ সালে শহর থেকে কিছু দূরে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে আট একর ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেন শচীন্দ্র লাল ডিগ্রি কলেজ। দুতলা বিশিষ্ট ভবন, সুরমা উদ্যান, বিজয়লক্ষ্মী সরোবর, ছাত্রাবাস এবং মসজিদ নির্মাণ করেন এতে।

তিনি ১৯৯৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিংহগ্রামে বিজয়লক্ষ্মী হাইস্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯২ সালে হবিগঞ্জ রামকৃঞ্চ মিশনে শচীন্দ্র লাল সরকার নামে শিক্ষা বৃত্তি চালু করেন তিনি। এছাড়া ১৯৯৯ সালে শচীন্দ্র কলেজের পাশে শ্রী চৈতন্য সংস্কৃতি মহাবিদ্যালয় স্থাপন করেন।

তার অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে ১৯৯৮ সালে হবিগঞ্জ রামকৃঞ্চ মিশন আশ্রমে দূর্গা মন্দির স্থাপন, ১৯৯৬ সালে শ্রীমঙ্গলের রুস্তমপুর গ্রামে শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জিউড় মন্দির স্থাপন। এরপর ১৯৯৭ সালে তার সমস্ত সম্পত্তি ধর্মসেবা ও গরিবদের সেবায় দেবোত্তর দান করেন।

সগ্রামী ও জনধরদি এই মানুষটি ১৯৯৮ সালে বানিয়াচংয়ের নাগুড়ায় প্রাকৃতিক ও মনোরম পরিবেশে ‘শচীন্দ্র কলেজ’ নামে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন শচীন্দ্র লাল সরকার। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এলাকার শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এই কলেজটি। বর্তমানে কলেজটিতে ৩টি বিষয়ে অনার্সসহ প্রায় ৩ হাজার ৫শ’ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন।

১৯৩৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন শচীন্দ্র লাল সরকার। পিতা স্বর্গীয় চাঁদ সরকার মাতা স্বর্গীয় নিরদাময়ী সরকার। পিতা চাঁদ সরকার পেশায় একজন কাঠ মিস্ত্রি ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন। হিন্দু ধর্মীয় পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ পান। দেশ ভাগের ফলে তার পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে যেতে হয় তাকে। পরে আবার দেশে ফিরে আসেন। লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবার ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের অভাব অনাটনের কারণে আর হয়ে উঠেনি। সংসারের হাল ধরতে শহরের ঘাটিয়া বাজার এলাকায় সুলভ বস্ত্রালায় (নয়া হাজারী) সাধারণ কর্মচারী হিসেবে চাকরি নেন। সেখানে তিনি শ্রম মেধা ও সততার মাধ্যমে সকলের মন জয় করে নেন। দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে নিজেকে একজন দক্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলেন। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে পরে নিজেই ঘাটিয়া বাজারে একটি ছোট্ট কাপড়ের দোকান খোলেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে নিজেকে সফল ব্যবসায়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।