বজ্রপাতের হটস্পট হবিগঞ্জ ॥ শুধু বৈশাখেই ৭ কৃষকের প্রাণহানী
তারিখ: ১৪-মে-২০২৫
আখলাছ আহমেদ প্রিয় ॥

 সারাদেশে বজ্রপাতের যেসব হটস্পট রয়েছে এর মধ্যে হবিগঞ্জ অন্যতম। বৃৃষ্টি এলেই শুরু হয় ঝড়ো হাওয়া। মূহুর্তেই অন্ধকারাচ্ছ্বন্ন হয়ে পড়ে আকাশ। বিদ্যুৎ চমকালেই দেখা দেয় আকষ্মিক বজ্রপাত। এতে মূহুর্তেই ঘটে কৃষক ও শ্রমিকের প্রাণহানী। হবিগঞ্জে চলতি মৌসুমে বজ্রঘাতে মারা গেছেন ৮ জন কৃষক ও শ্রমিক। এর মধ্যে শুধু বৈশাখেই মারা গেছেন ৭ জন। আর আহত হয়েছেন ৩ জন। এদিকে, বজ্রপাঘাতে নিহত স্বামীকে হারিয়ে মাথায় চিন্তার ভাজ পড়েছে জেলার বানিয়াচং উপজেলার গৃহিনী যোগমায়া দাসের। ২ শিশু সন্তানকে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবেন এখন দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। 
স্থানীয় সূূত্র  জানায়, গত সোমবার (১২ মে) সকাল সাড়ে ৯টায় লাখাই উপজেলার সুজনপুর গ্রামের আজগর আলী নিজের গরু চড়ানোর জন্য ধলেশ্বরী নদীর তীরে যান। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আগের দিন রোববার (১১ মে) বিকেলে ধানের জমিতে পানি দেয়ার নালায় গোসল করতে যান আজমিরীগঞ্জ উপজেলার ডেমিকান্দি গ্রামের সাজু মিয়া। এতে বজ্রঘাতে তার মৃৃত্যু হয়। গত ২৮ এপ্রিল গ্রামের হাওড়ে ধান কাটায় ব্যস্ত ছিলেন বানিয়াচং উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়ন আড়িয়ামুগুর গ্রামের ৪ ভাই। তখনই বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হয় ঝড়ো হাওয়া। বিদ্যুৎ চমকাতেই শুরু হয় আকষ্মিক বজ্রপাত। ভয়ে ৪ ভাই একত্রে বসেন। এ সময় বজ্রঘাতে মারা যান দুর্ব্বাশ কান্তি দাস। এতে আহত হন তার ৩ সহোদর সুধন্য দাস, ভূূষন দাস ও মোহন লাল দাস। বজ্রপাতে আহত হয়ে মাঠেই পড়ে থাকেন তারা। স্থানীয়রা তাদেরকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্র্তি  করেন। তবে বজ্রঘাতে দুর্ব্বাশ দাসের মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়েছে তার পরিবার। ৫ বছরের ছেলে প্লাবন ও আড়াই বছরের কন্যা সন্তান লাভনী দাসকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তিনি। স্বামীর ঋন পরিশোধ এবং সংসার কিভাবে চালাবেন এটি এখন চিন্তার বিষয়। 
দুর্ব্বাশ দাসের স্ত্রী যোগমায়া দাস বলেন, ‘মাঠে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান আমার স্বামী। তিনি মারা যাবার পূর্বে অনেক টাকা ঋণ করে টিনসেড ঘর নির্মাণ করেছিলেন। বর্র্ষা মৌসুমে বাড়ির পাশের অংশ ভেঙে যায়। এবার যদি ভেঙে পড়ে কিভাবে মেরামত  করবো বুঝতে পারছি না। ঋণ পরিশোধই করবো কিভাবে আবার সংসার চালাবো কি করে এই চিন্তা পড়েছি। এখন আমি খুবই  অসহায় হয়ে পড়েছি। 
বজ্রপাতে  আহত দুর্ব্বাশ দাসের সহোদর ভুষন দাস বলেন, ‘আমরা ৪ ভাই মাঠে কাজ করছিলাম। হঠাৎ বজ্রপাত শুরু হলে আমার পাশেই ছোট ভাই দুর্ব্বাশ মারা যায়। নিজেও আহত হয়েছি। টাকার জন্য নিজের চিকিৎসা করতে পারছি না’। 
সুধন্য দাস বলেন, আমার পাশে থাকা দুর্ব্বাশ দাসের উপর সরাসরি বজ্রঘাত করে। আমরা ৩ ভাই চারদিকে উড়ে যাই। কিছুক্ষন পর হাটুগুড়ি দিয়ে উঠে এসে দেখি দুর্ব্বাশ মারা গেছে। আমার অপর ভাই মোহনলাল বাড়িতে এসে খবর দেয়। 
হবিগঞ্জ জেলা ত্রান ও পুনর্বাসন অফিসের তথ্যনুযায়ী, বৈশাখ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত জেলায় দুর্ব্বাশ দাস, আজগর আলী ও সাজুু মিয়া ছাড়াও আরও ৫ কৃষক ও শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল বিকেলে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা ইউনিয়নের হাওড়ের দক্ষিণের ঝিলেরবন্দ এলাকায় ধান কাটতে যান একদল শ্রমিক। এসময় হঠাৎ করে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হলে দুই শ্রমিক বজ্রঘাত হন। এতে ঘটনাস্থলেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার মোহনবাগ গ্রামের মনিরুল ইসলাম ও পার্বতীপুর গ্রামের আব্দুল্লাহিল কাফি নিহত হন। একই দিন নবীগঞ্জ উপজেলার দীঘলবাক ইউনিয়নের বনকাদিপুর গ্রামের হাওরে গুরু চরাতে গিয়ে বজ্রাঘাতে শাহ আলম নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। নিহত শাহ আলম ওই গ্রামের মৃত আব্দুল আকিল মিয়ার ছেলে। ১৫ এপ্রিল বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি হাওড়ে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রঘাতে নিহত হন মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারী গ্রামের শ্রমিক মোঃ কাদের মন্ডল। এর আগে ২৩ ফেব্রুয়ারী নবীগঞ্জ উপজেলার রামপুর গ্রামের বিলে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রঘাতে নিহত হন কৃষক নিজাম উদ্দিন। প্রশাসনের পক্ষ হবিগঞ্জ জেলায় বসবাসরত মারা যাওয়া কৃষকদের ২৫ হাজার ও আহতদের ১৫ হাজার টাকা করে অনুদান  প্রদান করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাদের রহমান বলেন, ‘বজ্রপাতে নিহত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। তাৎক্ষনিকভাবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত ও আহতদের পরিবারকে ২৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। হাওর এলাকা মনিটরিংয়ের পাশপাাশি বজ্রপাত প্রবণ এলাকায় আশ্রয়ন চাউনি ও বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে’। 
জেলা প্রশাসক ড.ফরিদুর রহমান জানান, হবিগঞ্জে বজ্রপাতে প্রায়ই কৃষক ও শ্রমিক মারা যাচ্ছেন। আমরা ইতিমধ্যে বজ্রপ্রবণ এলাকায়  বজ্রনিরোধক দন্ডসহ আশ্রয়ন কেন্দ্র স্থাপনে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি’।