আখলাছ আহমেদ প্রিয় ॥
সক্রিয় বনদস্যুরা ॥ সাতছড়ি ও রেমা কালেঙ্গায় থামছে না গাছ দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক বন চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি ও রেমা কালেঙ্গা। সাতছড়ি ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর আয়তনের বনভূমি আর ১৭.৯৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তন জুড়ে অবস্থিত রেমা কালেঙ্গা বনাঞ্চল। এর মধ্যে রেমা-কালেঙ্গা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। একসময় যেখানে বড় আকৃতির মূল্যবান গাছ আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রের দেখা মিলত, সেখানে এখন নেমে এসেছে নীরবতা। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভুমি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সাতছড়ি। তবে রেমা কালেঙ্গা ও সাতছড়ি থেকে অব্যাহত গাছ পাচার ও দস্যুদের তাণ্ডবে আজ হুমকির মুখে পরিবেশ । বছরের পর বছর ধরে চলা অবৈধ গাছ পাচারে আজ এই অভয়ারণ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সম্প্রতি বনদস্যুদের তৎপরতা আরও বেড়েছে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চল ও সাতছড়ি সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কাই করছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবিদরা।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত ১৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র কৌশলে সংরক্ষিত বনে প্রবেশ করে পরিকল্পিতভাবে তিনটি বড় সেগুন গাছ কেটে পাচার করে। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট বনরক্ষী সুমন বিশ্বাসকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিয়েছে বন বিভাগ। স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বন টহল কর্মীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা ছাড়া এ ধরনের দুঃসাহসিক চুরি সম্ভব নয়। ঘটনার ৮ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো চোরাই সেগুন গাছ উদ্ধার করতে পারেনি বন বিভাগ বরং এ ঘটনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত বনরক্ষীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে বন রক্ষায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকা নিয়েও উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। স্থানীয়দের দাবি, স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই সামান্য বেতনের বিপরীতে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন ও অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। তাদের একটি অংশ গাছ পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে বন রক্ষার দায়িত্বে থাকা এই ব্যবস্থাই উল্টো বন ধ্বংসের পথ সুগম করছে বলে মত স্থানীয়দের।
বনরক্ষীরা স্বীকার করেছেন, সম্প্রতি একটি শক্তিশালী ও সংগঠিত চোরচক্র বনজ সম্পদ লুটে নিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও শক্ত নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গভীর রাতে দ্রুত গাছ কেটে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। সাতছড়ির ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত যা ভেতরের সহায়তার সন্দেহ আরও জোরালো করেছে।
অন্যদিকে, গত মঙ্গলবার রাত আনুমানিক ৮টার দিকে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ মহাসড়কে এক যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণ চোরাই গাছসহ একটি ট্রাক জব্দ করে বন বিভাগ ও র্যাব। অভিযানে নেতৃত্ব দেন শায়েস্তাগঞ্জের ফরেস্টার ও ডেপুটি রেঞ্জার আশিকুর রহমান। অভিযানে অংশ নেয় শায়েস্তাগঞ্জ সিপিসি র্যাব-৩ ক্যাম্পের একটি টিম। এ সময় ট্রাকের চালক ও হেলপারসহ মোট পাঁচজনকে আটক করা হয়। এর আগে ফরেস্টার বাদী হয়ে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে অভিযুক্তদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত ১১ ডিসেম্বর গভীর রাতে কালেঙ্গা বিটের নিশ্চিন্তপুর পাহাড় এলাকায় সংঘবদ্ধ একটি চক্র সেগুন গাছ কাটতে গেলে বনরক্ষীদের সঙ্গে তাদের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন সশস্ত্র পাচারকারীর সঙ্গে আধাঘণ্টার বেশি সময় ধরে বন্দুকযুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে জনবল সংকটে বনরক্ষীরা পিছু হটতে বাধ্য হন। পরে খবর পেয়ে বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দস্যুরা পালিয়ে যায়।
সাতছড়ি বন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা নিজামুল হক বলেন, “গত কয়েক বছরে সাতছড়িতে বড় গাছ চুরির ঘটনা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই একটি চক্র সরকারি সম্পদ লুটে নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এর আগে রেমা-কালেঙ্গা বনে গাছ চুরি ঠেকাতে গিয়ে বনরক্ষী ও বনদস্যুদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনাও ঘটে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সাতছড়িতে আবার সেগুন চুরি এটা খুবই উদ্বেগজনক।” স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক মিয়া বলেন, “সীমিত জনবল দিয়ে বিশাল বনাঞ্চল রক্ষা করা কঠিন। এই সুযোগেই বনদস্যুরা আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে গাছ কেটে পাচার করছে। বন রক্ষা করতে হলে স্বেচ্ছাসেবক ব্যবস্থার সংস্কার ও নজরদারি বাড়ানো জরুরি।”
সাতছড়ি বিট অফিসার আনোয়ার হোসেন জানান, চুরি যাওয়া সেগুন গাছ উদ্ধারে বন বিভাগ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বনরক্ষী সুমন বিশ্বাসকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে এবং বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।