স্টাফ রিপোর্টার ॥
নবীগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদী যেন এখন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের অবাধ লুটপাটের মাঠ। দিনের পর দিন প্রকাশ্যেই নদীর বালু গিলে খাচ্ছে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির নেতারা। তারা ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চললেও তা ঠেকাতে প্রশাসনের কার্যকর কোনো ভূমিকা চোখে পড়ছে না। বরং দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কুশিয়ারার বালুর নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হচ্ছে এমন অভিযোগ উঠেছে স্থানীয়দের মধ্যে। জানা যায়, নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের পাহাড়পুর, পারকুল, দুর্গাপুরসহ আশপাশের এলাকায় কুশিয়ারা নদী বর্তমানে অবৈধ বালু উত্তোলনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের সংযোগস্থল শেরপুর অঞ্চলের এই নদীপথে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬টি ড্রেজার বসিয়ে বিপুল পরিমাণ বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে নদীর উভয় তীরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তীরবর্তী জনপদের মানুষ।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো এই অবৈধ বালু উত্তোলনের নেতৃত্বে রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ওয়াহেদুল করিম চৌধুরী ওরফে নকীবের মালিকানাধীন ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে এই অবৈধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অথচ সাউথ এশিয়ান সাব-রিজিওনাল কোঅপারেশন (সাসেক)-এর আওতায় ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য তাজাবাদ ও দীঘলবাক মৌজার নির্দিষ্ট এলাকায় সীমিত পরিসরে ড্রেজিংয়ের অনুমতি থাকলেও বাস্তবে তার শর্ত মানা হচ্ছে না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সিলেট আঞ্চলিক দপ্তরের অনুমোদনের শর্ত উপেক্ষা করে বহুদিন ধরেই অনুমতির বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলন চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি অনুমোদিত বালুর পরিমাণ বহু আগেই শেষ হলেও এখনো প্রকাশ্যে বালু তুলে বিভিন্ন পক্ষের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে মহাসড়কের কাজে দেওয়ার নাম ব্যবহার করে।
অভিযোগ রয়েছে, এই বালু ব্যবসায় স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করে আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহেদুল করিম চৌধুরী অবৈধ কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় বিএনপি নেতা সাজু মিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেতা দুলাল মেম্বারসহ দুই দলের একাধিক নেতা এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বালু উত্তোলন কার্যক্রমের উদ্বোধনকালের ছবিতে সামনের সারিতে আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহেদুল করিম চৌধুরীর পাশে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের উপস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কাগজপত্র পর্যালোচনা ও অভিযোগের সূত্র অনুযায়ী, বালু উত্তোলনের চুক্তিপত্র সম্পাদনের সময় ওসমানীনগর এন্টারপ্রাইজসহ অন্তত পাঁচটি এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহেদুল করিম চৌধুরীর পক্ষে জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নাম ভাঙিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলন থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন সাজু মিয়াগং। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অবৈধ বালু উত্তোলনের পাশাপাশি অবৈধ পাহাড় কাটা এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক অবস্থান ও ভাবমূর্তি। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। লাগাতার বালু উত্তোলনের ফলে কুশিয়ারা নদীর দুই তীরে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ, বসতভিটা ও জনপদ। নদীর মাঝখানে প্রকাশ্যে ড্রেজার বসানো হলেও কার্যকর প্রশাসনিক উদ্যোগ না থাকায় হতাশ পরিবেশবাদীরা। তাদের ভাষায়, রাজনৈতিক প্রভাবে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন কুশিয়ারার ভাঙনকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে বড় ধরনের পরিবেশগত ও মানবিক বিপর্যয় অনিবার্য। স্থানীয়দের প্রশ্ন যেখানে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে ড্রেজার চলে, সেখানে এই অভিযান আদৌ কতটা কার্যকর, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। এ বিষয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে’।