আখলাছ আহমেদ প্রিয় ॥
শীত মৌসুমে জেলা জুড়ে কৃষি জমি থেকে অবাধে মাটি কাটার ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। যা খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষির জন্য হুমকিস্বরূপ। জমির উপরের উর্বর মাটি (টপ সয়েল) কেটে নেয়ার ফলে জমির ফলন কমে যায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। যা খাদ্য উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং খাদ্য সংকট তৈরি করতে পারে এমনটাই বলছেন পরিবেশবিদরা। কৃষিজমি শুধু খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র নয়, এটি পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্রেরও গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। অথচ হবিগঞ্জ জেলায় প্রতি বছর শীত মৌসুম এলেই এক শ্রেণির মুনাফালোভী মাটিখেকো চক্র কৃষিজমির এই প্রাণভিত্তিক স্তর উর্বর টপসয়েল, নির্মমভাবে কেটে নিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনিক নজরদারির দুর্বলতার সুযোগে জেলার শায়েস্তাগঞ্জ, বাহুবল, নবীগঞ্জ ও চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন কৃষি জমি থেকে মাটি খেকোরা প্রতিদিন প্রকাশ্যে মাটি উত্তোলন করে বিক্রি করছে। বিস্তীর্ণ কৃষিজমি থেকে নিয়মিতভাবে মাটি কাটা হচ্ছে। এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি উত্তোলন করে ট্রাক্টর দিয়ে মাটি পাচার করা হয় জেলার বিভিন্ন এলাকায়। কৃষকদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে টপসয়েল কিনে নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত স্থাপনায় বিক্রি করা হচ্ছে কয়েক গুণ দামে। এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি সংঘবদ্ধ মধ্যস্বত্বভোগী চক্র দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব খাটিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে সহজেই মাটিখেকোরা অতিরিক্ত লাভবান হচ্ছেন। এদিকে, এক্সকেভেটর ও ট্রাক্টরের অবাধ ব্যবহারে কৃষিজমির উর্বরতা ধ্বংসের পাশাপাশি মাটির প্রাকৃতিক গঠন নষ্ট হচ্ছে।
সম্প্রতি লাখাই উপজেলার বামৈ ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছোট্ট মিয়া ও তার সহযোগীরা মন্মন হাওর এলাকার ফসলি জমি থেকে মাটি উত্তোলন করছিলেন। গত বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় চারটি মাটিবোঝাই ট্রাক্টর আটক করেছেন স্থানীয় লোকজন। এ সময় ট্রাক্টরের মালিক ও চালকেরা পালিয়ে যান। পরে রাত ১০টার দিকে ইউপি চেয়ারম্যান আরিফ আহমেদ রূপনের উপস্থিতিতে ট্রাক্টরগুলো লাখাই থানার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) দুপুরে বাহুবল উপজেলার সদর ইউনিয়নের জয়নাবাদ এলাকায় কৃষি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি কাটার দায়ে নানু মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাহুবল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল ইসলামের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করে তাকে জরিমানা করা হয়। একই দিন নবীগঞ্জ উপজেলার ফার্মবাজার সংলগ্ন উর্বর ধানী কৃষি জমিতে অনুমতি ছাড়া এক্সেভেটর দিয়ে মাটি কাটার অভিযোগে বাগাউরা মৌজার হরিনগর গ্রামের জামাল শাহকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় দুই ট্রাক্টর মাটি জব্দ করে নবীগঞ্জ পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করে প্রশাসন।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) নবীগঞ্জের ছোট ভাকৈর এলাকায় এক্সেকেভেটর দিয়ে মাটি কাটায় সেলিম মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যয় হাশেম। একই দিন সরকারি অনুমতি ছাড়া কৃষিজমি থেকে মাটি কাটা ও জমির শ্রেণী পরিবর্তনের দায়ে দক্ষিণ উমরপুর মৌজার এক ব্যক্তিকে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযানের সময় অবৈধভাবে কাটা মাটি জব্দ করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানার অর্থ আদায় করা হয়। অন্যদিকে, অন্যদিকে, শায়েস্তাগঞ্জের ব্রাহ্মনডোরা ইউনিয়নের শেরপুর, কেশবপুর, ঋষিপাড়া এলাকা থেকে নিয়মিত মাটি উত্তোলন করছে একটি চক্র। তারা কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি ট্রাক্টর টপসয়েল ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় ক্রয় করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করে। পরিবেশ সচেতন মহলের মতে, হবিগঞ্জ জেলার নদী, হাওর ও কৃষিভিত্তিক পরিবেশ ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ মোকাবিলা করছে। এর ওপর নির্বিচারে টপসয়েল কাটা হলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা কমে যাবে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়বে।
শায়েস্তাগঞ্জের ব্রাহ্মনডোরার শিপন মিয়া নামে এক ব্যক্তি বলেন, প্রতিদিন মাটি তুলে ট্রাক্টর দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। এতে কিছু বললে, তারা টাকা দিয়ে মাটি ক্রয় করে বিক্রি করছে বলে জানা। বাহুবলের জয়নাবাদ গ্রামের রাজু মিয়া বলেন, ‘প্রতিদিন ৮/১০টি মাটি ভর্তি ট্রাক্টর বাড়ির রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করে। স্থানীয় ব্যক্তিরা সহযোগিতা করায় কেউ কিছু বলেনা’।
লাখাই ইউপি চেয়ারম্যান আরিফ আহমেদ রূপন বলেন, ‘হাওর থেকে ফসলি জমির উর্বর মাটি কেটে নেওয়ায় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ ছিলেন। জমির মালিকেরা ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারছিলেন না। পরে সবাই একত্র হয়ে ট্রাক্টরগুলো আটক করেন।
লাখাই থানার উপপরিদর্শক মাসুদ রানা বলেন, ‘আটক ট্রাক্টরগুলো ইউপি সদস্য ছোট্ট মিয়ার বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এ ঘটনায় নিয়মিত মামলা করা হবে নাকি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে- সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াধীন।
হবিগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘কৃষিজমি দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। অপরিকল্পিতভাবে মাটি কাটা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং খাদ্য উৎপাদনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। কৃষি জমি থেকে এক্সেকেভেটর দিয়ে মাটি উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনকে কাঠোর হতে হবে’।
বাহুবল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যখন খবর পাই তখনই অভিযান চালাই। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে মাটি খেকোদের জরিমানা করা হচ্ছে’।
নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রত্যয় হাশেম বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মাটি কাটা বন্ধে প্রশাসন কঠোর রয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে’।
শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাহিদ হোসেন জানান, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’।