একনজর দেখতে শতশত জনতার ভীড় ॥ ভন্ডামি নাকি কেরামতি ॥ শহরতলীর নয়াপাতারিয়া গ্রামে কবর থেকে উঠে এলেন কথিত জিন্দাবাবা!
তারিখ: ৩০-মার্চ-২০১৫
কাউছার আহমেদ টিপু ॥

হবিগঞ্জ শহরতলীর নয়াপাতারিয়া গ্রামে ৩দিনের জন্য স্বেচ্ছায় কবরে (কবরচিল্লা) শেষ করে জীবন্ত বেরিয়ে এলেন ‘জিন্দাবাবা’ নামে পরিচিত কথিত পীর জিতু মিয়া ওরফে জিন্দাশাহ। বানিয়াচঙ্গ উপজেলাধীন নয়াপাথারিয়া গ্রামে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে যখন কবর খুঁড়ে ‘জিন্দাবাবা’কে বের করে আনা হয় তখন সেখানে হাজার হাজার জনতর ঢল নামে। কেউ বলছেন এটিকে কেরামতি। আবার কেউ বলছেন এটি ভন্ডামি। তবে জিন্দাবা ইস্যুটি ছিল হবিগঞ্জের আলোচ্য বিষয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিন দিন পূর্বে যখন ৮৬ বছর বয়স্ক জিতু মিয়াকে কবর এর ভেতরে প্রবেশ করানো হয় তখন তার সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল ৩শ গ্রাম আঙ্গুর আর একটি বিস্কুটের ‘বৈয়াম’। মঙ্গলবার যখন কবর থেতে তাকে বের করা হয় তখন কবরের ভিতর কোন প্রসাব-পায়খান ছিল না। স্থানীয় লোকজন ও জিতু মিয়ার পারিবারিক সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা গ্রামের বাসিন্দা টেকাই মিয়ার পুত্র জিতু মিয়া প্রায় ২৫ বছর পূর্বে নবীগঞ্জ উপজেলার তিমিরপুর গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। সেখানে জিতু মিয়া (৮৬) স্ত্রী সন্তানদের রেখে বিভিন্ন মাজারে গিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনা করেন। প্রায় ১ সপ্তাহ পূর্বে তিনি নয়াপাথারিয়া গ্রামে আসেন। এরপর হাত-পা বেঁধে গ্রামের বিভিন্ন পুকুরে ভেসে থেকে তিনি আধ্যাত্মিক কেরামতি দেখান। পুকুরে তার ভেসে থাকা দেখে গ্রামের লোকজন তার পীর হিসেবে বিশ্বাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ওই গ্রামের মেন্দি মিয়ার পুকুর পাড়ে গিয়ে আস্তানা করার জন্য অবস্থান নেন। প্রথমে মেন্দি মিয়া ও তার পরিবারের লোকজন জায়গা দিতে অনিহা প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাকে জায়গা দেন। এরপর তার পুকুরের মধ্যে দীর্ঘ সময় ভেসে থাকলে মেন্দি মিয়ার পরিবারের লোকজন তাকে বিশ্বাস করেন এবং তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। জিতু মিয়া ওরফে জিন্দাশাহ তাদের জানান, তিনি কবর খুঁড়ে ৩ দিনের জন্য চিল্লায় যাবেন। এতে তারা অনেকটা ভয় পেয়ে যান। তার কথা শুনে গ্রামের লোকজনদের দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে আনেন মেন্দি মিয়া। মেন্দি মিয়ার পুত্র জুয়েল মিয়া গ্রামবাসীর সাথে জিন্দাশাহর বিষয়ে কথা বলেন। জিতু মিয়া গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন- এর আগেও তিনি একাধিকবার কবরে অবস্থান করেছেন। তিনি জানান, গত ৪৫ বছর ধরে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন মাজারে মাজারে ‘সাধনা’ করেছেন। তিনি হবিগঞ্জ শহরতলীর মরহুম আধ্যাত্মিক সাধক দেওয়ান মাহবুব রাজার ভক্ত। স্বপ্নের মাধ্যমে মাহবুব রাজার কাছ থেকে ‘চিল্লা’য় যাওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন তিনি। ‘চিল্লা’ মানে হচ্ছে কবরে প্রবেশ করা। জিতু মিয়া বলেন, ‘এর আগে ১১ বার আমি চিল্লায় গিয়েছি। আর এটাই আমার শেষ চিল্লা।’ তিনি বলেন, ‘আমি নিজের ইচ্ছায় কবরে যাচ্ছি। আমি আগেও গিয়েছি। যদি কোথাও লিখে বলতে হয় আমি তাও রাজি আছি। আমি যদি মারাও যাই তবুও কেউ দায়ী নয়। আমার দায়দায়িত্ব আমার।’ তার কথামতো রবিবার ৩ দিনের চিল্লায় যাওয়ার দিন ঠিক করা হয়। এর পূর্বে পুকুরপাড়ে গ্রামের জুয়েল মিয়াসহ কয়েকজন টাকা উত্তোলন করে একটি ছাপ্টা ঘর তৈরি করেন।

মঙ্গলবার যখন তাকে কবর থেকে উত্তোলন করে গ্রামের উমর আলীর বাড়ীতে আনা হয় সেখানে সাংবাদিকদের তিনি জানান, তিনি দেওয়ান মাহবুব রাজার হুকুমে চিল্লায় গেছেন। এবার তিনি আগুনে প্রবেশ করে সবাইকে দেখাবেন। তিনি নিজেকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নয় বলে স্বীকার করলেও স্বপ্নে মাহবুব রাজার হুমুক থেকে এ ধরনের কাজ করেছেন বলে জানান।

‘জিন্দাবাবা’ জিতু মিয়াকে জায়গা দানকারী মেন্দি মিয়ার পুত্র জুয়েল মিয়া জানান, শনিবার সকাল ১১টায় হাজারো মানুষের সামনে তিনি হাত-পা বাধা অবস্থায় প্রায় ৪০ মিনিট পুকুরের পানিতে ভেসে থাকেন। ‘জিন্দাবাবা’ জিতু মিয়ার পুত্র শামীম মিয়া জানান, তার বাবা আরও কয়েকবার চিল্লায় গিয়েছেন। তবে তারা দেখেননি। এটি তারা প্রথম দেখেছেন।

এদিকে তার আস্তানাকে ঘিরে ইতোমধ্যে ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করেছে। পাথাড়িয় গ্রামের বৃদ্ধ আফরোজ মিয়া জানান, এই ঘটনায় এলাকার উন্নয়ন হবে। এখন কাম হইয়া গেছি গা। কেউ কেউ বলছেন ‘বাবা ভর কর’। লুকড়া গ্রাম থেকে আসা আব্দুর রউফ বলেন, ‘বেটা আউলিয়া হইয়া গেছে’। কাশিপুর থেকে আসা আব্দুর রহিম বলেন, ‘পাথাইড়া গ্রামবাসীর কপাল খুলছে’। হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, এটি এক ধরনের যাদু ও ভন্ডামি। সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করে ব্যবসা করার ফন্দি থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। সনাতন ধর্মালম্ভিদের চড়ক পূযায় ও এ ধরনের চমক দেখানো হয়।

এলাকার অনেকেই বলেছে এটি কালি সাধনার মাধ্যমে কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।

হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজার জামে মসজিদের ইমাম মুফতি আব্দুল মজিদ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি। হবিগঞ্জের বিশিষ্ট মুফতি মাওলানা জাবের আল হুদা এটিকে এক ধরনের ভন্ডামি হিসাবে উল্লেখ করেন।

বানিয়াচং থানার ওসি অমূল্য কুমার চৌধুরী জানান, বিষয়টি উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিংএ উপজেলা চেয়ারম্যান উত্তাপন করেছেন। এটি এক ধরনের ভন্ডামি। কিন্তু এরই মধ্যে তার হাজার হাজার ভক্ত সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ গেলে সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। তাই সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়নি।

প্রথম পাতা
শেষ পাতা